Friday, June 19, 2015

একজন ভালো পুরুষের বৈশিষ্ট্য

সাইফুল্লাহ সাদেক
আমাদের সমাজের পুরুষরা কেমন যেন দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। নিজের পৌরষত্ব দেখানোর জন্য কোন না কোন দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কিন্তু তাই বলে কি ভালো পুরুষ নেই? অবশ্যই আছে। তবে ভালো পুরুষ না মন্দ পুরুষ কেমনে বুঝবেন? এই হলো প্রশ্ন। একটু পর তার উত্তর পাবেন।
অনেকেই শুধু সুন্দর দেখেই সম্পর্ক জড়িয়ে পড়েন। অনেক নারী পুরুষের সৌন্দর্য, অভারস্মার্ট, ক্রেজি ভাব দেখে ভাল মন্দ যাচাই না করেই প্রেমে হাবুুডুবু খান। প্রেমে অন্ধ হয়ে পড়েন। মনোবিদরা বলছেন, শুধু সুন্দর দেখে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়া খুব অনুচিত এবং এটা বড় ভুল। মূলত সবচেয়ে জরুরী একজন ভালো মানুষকে ভালোবাসতে পারা। ওভারস্মার্ট, ফ্যাশনেবল কিংবা অর্থবিত্ত বেশি দেখে নয়, একজন নারীর জন্য একজন ভালো মানুষকে জীবনসঙ্গী করা খুব জরুরী। কেননা, একজন ভালো মনের পুরুষ কখনো আপনাকে অত্যাচার করবে না, কষ্ট দেবে না, অপমান করবে না, তাঁর কাছে একজন নারী থাকবে সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাহলে চলুন নিচের বিষয়গুলি দেখে আপনার প্রিয় পুরুষটি কতোটা ভালো মানুষ জেনে নেয়া যাক।
সত্য প্রকাশ: একজন ভালো মনের পুরুষ কখনোই ভালোবাসা প্রকাশে দ্বিধা করবেন না। তিনি সবসময়ই সত বলতে প্রস্তুত থাকেন। যেকোনো কঠিন মুহূর্তেও একজন ভালো মানুষ সত্য বলেন এবং তার সঙ্গীকে সুখে রাখার চেষ্টা করেন। তাছাড়া সত্য প্রকাশে সংকোচ কীসের?
পাশে থাকবেন: একজন ভালো পুরুষ সব সময়েই আপনার পাশে থাকবেন, আপনাকে সার্পোট দেবেন। জীবনের কঠিন মুহূর্তে আগলে রাখবেন।
উৎসাহ দাতা: একজন ভালো মনের পুরুষ কখনো কাউকে নিরুৎসাহিত করেন না। তিনি আপনাকে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে সর্বাদা উৎসাহ যোগাবেন। প্রিয়জনকে তো করেনই, আশপাশের মানুষগুলিকেও তিনি ভালো কাজের উৎসাহ দেন।
বিশ্বাস ধরে রাখেন: একজন প্রকৃত পুরুষ বা ভালো পুরুষ আপনার বিশ্বাস অর্জন বিশ্বাস ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ভালো মনের প্রেমিক বা স্বামী আপনার বিশ্বাস ভঙ্গ হয় এমন কাজ করবেন না।
নিরাপদ স্থান: একজন ভালো পুরুষের সংস্পর্শে আপনি নিরাপদ বোধ করবেন, তিনি সর্বদা আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।
অপমান করেন না: একজন ভালা মানুষ কখনোই এমন কিছু করবেন না বা বলবেন না যার ফলে আপনি অপমানবোধ করেন। তিনি আপনার অসুন্দর মনে হয় এমন কিছুই করবেন না।
পছন্দকে গুরুত্ব দেবেন: একজন ভালো মানুষ সবসময় আপনার ছোটখাট সকল পছন্দ-অপছন্দকেই গুরুত্ব দেবেন। আপনার সবকাজের গুরুত্ব প্রথম আপনি তার কাছ থেকেই পাবেন যিনি ভালো মনের বা উদার মনের পুরুষ।
সম্মান ধরে রাখেন: জীবনের প্রতিটি সম্পর্কেই একটি নির্দিষ্ট সম্মানের সীমারেখা থাকে। একজন ভালো মনের পুরুষ সেই সম্মানের সীমারেখা লঙ্ঘন করবেন না।
সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করেন: কথা আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে, রক্ষা করা কঠিন’। একটি সম্পর্কের বেলাতেও তা গুরুত্বপূর্ণ। একজন ভালো মানুষ শুধু সম্পর্ক গড়েই ক্ষান্ত থাকেন না, সেই সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখার জন্য সারাজীবন চেষ্টা করবেন।
আপনার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেবেন: ভালো পুরুষ কখনোই অন্যের ইচ্ছায়, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একজন ভালো মানুষ কখনোই আপনাকে কিছু করতে বাধ্য করবেন না।
সৎ এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন: প্রকৃত ভালো মানুষ তিনিই যিনি অত্যন্ত সৎ এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। কেবল আপনার সাথেই নন, সবার সাথেই তিনি তা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। কেননা একজন ভালো পুরুষ জানেন, জীবনে সততার গুরুত্ব আজ হোক কাল পাওয়া যাবেই।
নির্যাতন করেন না: একজন ভালো মনের পুরুষ কখনোই আপনাকে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের কথা স্বপ্নেও ভাববেন না। শত অপমান সহ্য করেও ভালো মানুষ জীবনে এগিয়ে যেতে পারেন।
বিশ্বাস করেন: একজন প্রকৃত ভালো মানুষ কখনোই কারোর উপর আস্থা-বিশ্বাস হারান না। তিনি তার সঙ্গীকে কখনোই অবিশ্বাস করবেন না। আপনি তাঁকে অবিশ্বাস করেন এমন কোন কাজও তিনি করবেন না।
বদ অভ্যাস থাকবে না: একজন ভালো মানুষের নোংরা কোন বদ অভ্যাস থাকবে না। কখনো কোন নেশাজাতীয় দ্রব্য তিনি সেবন করবেন না, জীবনের শত প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। অতীতে তাঁর কোন বদ অভ্যাস থেকে থাকলেও আপনার খাতিরে সেগুলো তিনি ত্যাগ করবেন।
বাহ্যিক নয় মনের সৌন্দর্য: একজন ভালো মনের পুরুষ আপনার বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেবেন। কেননা, তিনি বুঝেন সৌন্দর্য সবসময় একই রকম থাকে না।
মানুষের জীবনের এই গূঢ় বাস্তবতাগুলি একজন ভালো মনের পুরুষই বুঝতে পারেন। কাজেই সম্পর্ক গড়ার আগে যাচাই করুন, আপনার প্রিয় পুরুষের মাঝে এই গুণসমূহ রয়েছে কিনা।

লোভী ডাক্তারদের চতুরতা থেকে সাবধান থাকুন

Monday, May 11, 2015

ভূমিকম্প সহনশীল ভবন কমাতে পারে ৯০ শতাংশ প্রাণহানি

বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প অনিবার্য হলেও জনগণ বা সরকার পর্যায়ে অসচেতনতা রয়েছে। মালিকরা ব্যয় সামান্য বাড়ালেই ভূমিকম্প সহনশীল ভবন হয়; কিন্তু তাঁদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে না। অবশ্য রানা প্লাজা ধসের পর থেকে সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে; নেপাল ভূমিকম্পও যথেষ্ট সতর্ক করে দিয়ে গেছে। আমাদের প্রযুুক্তিজ্ঞান আছে, সরঞ্জামাদি জোগাড় হচ্ছে। তবে বেশি প্রয়োজন সরকারের সচেতনতা। দেশের বিশিষ্ট ভূমিকম্প বিশ্লেষক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী কালের কণ্ঠের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমনই অভিমত ব্যক্ত করেন। অধ্যাপক আনসারী ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে একই বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তিনি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন। ড. আনসারী বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অফিস ফর আরবান সেফটি প্রকল্পের পরিচালনাসহ বিভিন্ন সংগঠনে দুর্যোগ নিয়ে কাজ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গাউস রহমান পিয়াস

কালের কণ্ঠ : নেপালে অনেক বড় ভূমিকম্প হলো। বাংলাদেশের ঝুঁকি নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে...।

মেহেদী আহমেদ আনসারী : আমাদের অবস্থা আসলে ততটা খারাপ না। গার্মেন্ট সেক্টরের কারণে দুই বছরে অনেক কাজ হয়েছে। আমি নেপালে গিয়েছিলাম দুইবার- ২০০৯ ও ২০১৩ সালে। শেষবার গিয়ে ইটের ভবনগুলো দেখিয়ে বলেছিলাম, দেখো, এগুলো টিকবে না। হলোও তাই। তাদের নতুন ভবনগুলো কিন্তু পড়েনি, যদিও তাদের ভবনের মান বেশ দুর্বল। আমাদের ইকুইপমেন্ট আছে, জ্ঞানও আছে। কিন্তু সরকারিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। কারণ সরকার নড়তে বললে তবেই আমরা নড়ি, আমরা বললে তো সরকার নড়বে না। সরকারের তরফে নির্দেশনা এলেই রিসোর্স মবিলাইজ করা যাবে। তাই সরকারকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। ডেইলি স্টারে এ সপ্তাহে একটি গোলটেবিল হলো ভূমিকম্প নিয়ে। এর আগে ২০০৫ সালে করেছিলাম। ২০০৫ থেকে এ পর্যন্ত আমরা অনেকগুলো ডকুমেন্ট দিয়েছিলাম। একটিও হয়নি। লাভ কী! আমাদের বলাই সার!

কালের কণ্ঠ : কিভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : প্রস্তুতি হবে তিন স্তরে। সাধারণ মানুষের প্রস্তুতি; জাতীয় প্রতিষ্ঠান যেমন- রাজউক, পিডাব্লিউডিসহ নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতি; সেই সঙ্গে প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা। এবার আমরা দেখেছি, ভয়ে লাফিয়ে পড়েও আমাদের এখানে আহত হওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। মানুষ ভবন থেকে দৌড়ে নেমে এসেছে। কিন্তু নিয়ম হচ্ছে, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, যেখানেই থাকি না কেন। আগে থেকেই জায়গা চিহ্নিত করে রাখা স্থানে আশ্রয় নিতে হবে- যেমন টেবিলের তলায় ঢুকে পড়া, দেয়ালঘেঁষে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। এরপর ভবন ভেঙে পড়লেও সেখানটায় একটা 'ট্রায়াঙ্গল অব লাইফ' পাওয়া যাবে। এ হচ্ছে ন্যূনতম পূর্ব সতর্কতা। দেখুন, নেপালে ভবনচাপা পড়েই বেশি লোক মারা গেছে। বলা হয়, ভূমিকম্প সহনশীল ভবন করা গেলে ৯০ শতাংশ প্রাণহানি কমানো যায়। ১০ শতাংশ মানুষ হয়তো পূর্ব সতর্কতা নিয়ে বাঁচতে পারে। তাই ভবন নিরাপদ করে নির্মাণ বা পুরনো ভবন হলে রেট্রোফিট করে নিতে হবে- যদিও শেষেরটি ব্যয়বহুল।

একটা উদাহরণ দিই। ২০১০ সালে বিশ্বে দুটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে- চিলি ও হাইতিতে। হাইতিরটি ছিল ৭.৩ এবং চিলিরটি ৮.৮। শক্তির বিচারে পরেরটি যদিও আট শ গুণ বেশি এনার্জি রিলিজ করেছিল, চিলিতে মারা যায় মাত্র ৫০০ জন; প্রাণহানি হাইতিতে ছিল তিন লাখের মতো। কারণ চিলি ১৯৬০ সালের ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০১০ পর্যন্ত ৫০ বছরে অনেক কিছু করেছে। তাই বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করলেই হাইতির থেকে চিলির বাস্তবতায় উত্তরণ সম্ভব।

এ ছাড়া জনগণের সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের প্রকৌশলী কমিউনিটি, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি খাত, সরকারি স্তর যেটাই হোক- সবাইকে সচেতন করতে হবে বিল্ডিং কোড মানার বিষয়ে। সেই সঙ্গে সরকারের কো-অর্ডিনেশনও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ জন্যই আমি মনে করি, আমাদের মেট্রোপলিটন গভর্নেন্সের দিকে যাওয়া উচিত। পৃথিবীর সর্বত্রই মেট্রো গভর্নমেন্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজটি করে থাকে। শিশু জিহাদের উদ্ধার বা রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দেখা গেছে, প্রশিক্ষিত বাহিনী ব্যর্থ হওয়ার পর অপ্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করেছে। এখানে বড় দুর্ঘটনা হলেই নেতা-কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। কিন্তু সারা বিশ্বে কর্মকর্তারা নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে বসে সব তথ্য নিয়ে সিদ্ধান্ত পাঠান। সমন্বয় নেই পুলিশের কাজেও। একটা রানা প্লাজা ধসের পর কী হলো আমরা দেখেছি। হাজার হাজার ভবন ভাঙলে কী অবস্থা হবে?

কালের কণ্ঠ : তো কী ধরনের ভবন ভূমিকম্প সহনশীল হয়ে থাকে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : বিল্ডিং কোডের বড় ব্যাপার হচ্ছে লাইফ সেফটি। অর্থাৎ ভবন যদি বিধ্বস্তও হয় মানুষের জীবন বেঁচে যাবে। এ জন্য কিন্তু প্রতি বর্গফুটে ২০ থেকে ২৫ টাকা খরচ করাই যথেষ্ট। কিছু রড বাড়তি দিতে হবে। বিল্ডিংটা যাতে বাঁশের মতো হয়, বাঁশ যেমন মচকায়, ভাঙে না; তেমন করে তৈরি করতে হবে। আরেক ধরনের ভবন হচ্ছে, বড় ঝাঁকুনিতেও একেবারেই ভাঙবে না। এটি বড় ব্যয়বহুল। ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা প্রতি বর্গফুটে খরচ বাড়ে। এ ধরনের ভবনকে বলা হয় ইমিডিয়েট অকুপেনসি।

ভূমিকম্প হলেও আমরা এমন ভবনে অবস্থান অব্যাহত রাখতে পারব। তবে লাইফ সেফটি ভবনের ক্ষেত্রে মজবুতীকরণ ছাড়া বাসযোগ্য হবে না। এ ধরনের ভবন আমাদের দেশে এখন অনেক আছে। এটিই মানুষ বেশি করে। আমাদের মতো অর্থনীতিতে এ ধরনের ভবন তৈরিই ভালো। পরবর্তী সময়ে রেট্রোফিট করে নেওয়াও এখানে সম্ভব। বিষয়টি হচ্ছে, বিল্ডিং কোড মেনে চলা। আমরা যেখানে পাঁচ হাজার টাকা বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনছি, ২০-২৫ হাজার টাকা দরেও কেউ কেউ কিনছে, সেখানে ২০ থেকে ২৫ টাকা বাড়তি ব্যয় হওয়া আসলেই নগণ্য বিষয়। আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে আছে- যেমন রাজউক, সিটি করপোরেশন বা অন্যান্য শহরে পৌর কর্তৃপক্ষ, তাদের ভূমিকা এখানে বড় গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের ভবন নির্মাণে বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করবে। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে আমার যেটা ধারণা, তাদের 'নলেজ লেভেলে' কমতি আছে। সাধারণ জনগণকেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তারা এখন বুঝতে পারছে না যে কোড মেনে চললে তারই লাভ।

আর নিজেদের বিষয়ে বলি, বুয়েটের ভবনগুলো আমরা ২০০৭ সালে অ্যাসেস করেছিলাম। এখন থেকে আমরা এগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করতে চাই। এখনো দেখভাল হচ্ছে। কিন্তু ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখে আরো জোরদারভাবে করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও একই অবস্থা। আমরাই তো সারা দেশের ভবন পরীক্ষা করি। আমাদেরই যদি এ অবস্থা হয়!

কালের কণ্ঠ : আমাদের তো বিল্ডিং কোড আছে। মানা কি হচ্ছে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : প্রায় না মানারই শামিল। একটা উদাহরণ দিই। রানা প্লাজা ধসের পরবর্তীকালে সরকার সাসটেইনেবল কমপেক্ট বলে একটা চুক্তি সই করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন সরকার ও আইএলওর সঙ্গে। এর এক বছর পার হয়েছে। চুক্তির একটি বিষয় ছিল শ্রমিকদের নিরাপত্তা। আরো ছিল ভবনের নিরাপত্তা ও অগ্নিনিরাপত্তা। ভবন নিরাপত্তার আওতায় আমরা দেশের তিন হাজার ৫০০ কারখানার মধ্যে দুই হাজার ৭০০-র মতো কারখানা এ পর্যন্ত পরিদর্শন করেছি। ভবনগুলোকে আমরা চারটি রঙে ভাগ করেছি; লাল- অর্থাৎ অবিলম্বে ভবনটি মজবুত করতে হবে, এর পরিমাণ ২ শতাংশেরও কম। বাকি রংগুলো হচ্ছে যথাক্রমে অ্যামবার, ইয়েলো ও গ্রিন। আমরা কিন্তু এই চিহ্নিতকরণ করেছি ওজন বিচারে এনে, কারণ রানা প্লাজার ঘটনা ঘটেছে মাত্রাতিরিক্ত ওজনের কারণে। ভূমিকম্পের বিষয়টি আমরা হিসাবে আনিনি। গার্মেন্ট খাতেই যদি বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরি হয়, তাহলে সাধারণ ভবনের ক্ষেত্রে তো না মানারই কথা। আমি মনে করি, আমাদের এই তথ্যগুলো ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করতে পারি।

আর ঢাকায় ১০ তলার অধিক যেসব সুউচ্চ ভবন রয়েছে, সেগুলো সম্ভবত ভূমিকম্প সহনীয় হবে। কারণ এ ধরনের ভবন নির্মাণে ঝড়-বাতাসের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়। লিফট কোডসহ অন্যান্য বিষয়ও হয়তো মানা হয়।

আর পাঁচ বছর ধরে বিল্ডিং কোড আধুনিকীকরণ নিয়ে কাজ চলছে। এ বছরই নতুন একটা বিল্ডিং কোড পাব। কিন্তু কোড তো বড় কথা না, প্রয়োজন বাস্তবায়ন। নতুন করেই বা কী, পুরনোটাই তো মানে না।

কালের কণ্ঠ : নেপালে কী ধরনের ভবন বেশি বিধ্বস্ত হয়েছে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : নেপালে যেসব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কিন্তু ইটের গাঁথুনির ছিল। ইটের গাঁথুনি আর বিম-কলাম পদ্ধতিতে তফাতটা আকাশ-পাতাল। বিম-কলাম থাকা মানেই হচ্ছে এগুলো কিছুটা হলেও ভূমিকম্প প্রতিরোধ শক্তি রাখে। বাঁশের মতো বেঁকে যাওয়ার কিছু বৈশিষ্ট্য তার থাকে, কারণ রড তো দেওয়া হচ্ছে। এ জন্যই আমরা বলে আসছি, আমরা যদি রড বাঁকিয়ে দিই, ঘন রড দিই, যাতে ২৫ টাকার মতো করে ব্যয় বাড়বে প্রতি বর্গফুটে। তাতে ভবনটি লাইফ সেফটি গুণের দিকে যায়। আমাদের এখানে ইটের গাঁথুনির ভবন অনেক কমে গেছে- ৩০ শতাংশের মতো হবে। ১০ বছর আগেও জরিপ করে দেখেছি, এটি ছিল ৫০ শতাংশের মতো।

সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি এখনই ভবন শনাক্তকরণের কাজটি শুরু করতে হবে। তাহলে হয়তো আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমরা প্রতিটি ভবনের মান চিহ্নিত করে দিতে পারব কালার কোড দিয়ে। তারপর চলবে মজবুত করার কাজ। রেট্রোফিট পদ্ধতিটি খুব ব্যয়বহুল। তবে সরকার বা দাতাদের অর্থায়ন হলে কাজটি ক্রমেই এগিয়ে নেওয়া যাবে।

কালের কণ্ঠ : উদ্ধার প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : আমরা বারবারই বলছি, ভবন যদি ভূমিকম্প সহনীয় হয়, তাহলে ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি সবই কম হবে। তার পরও উদ্ধারকাজ চালাতে হবে। সরকার কিন্তু প্রায় দুই বছর আগে ফায়ার সার্ভিস ও আর্মিকে ৬৯ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি দিয়েছে। তার মধ্যে আছে কাটিং মেশিন, সার্চার রেসকিউ ক্যামেরা, পাম্প মেশিন প্রভৃতি ছোটখাটো জিনিস কেনা। তবে ভারী যন্ত্র যেমন বুলডোজার, ডোজার এগুলো আমাদের আর্মি ও প্রাইভেট সেক্টরে অনেক আছে। ১৫০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার একটি উদ্যোগও পাইপলাইনে আছে। এ ছাড়া সরকার ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করারও উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে ৩০ হাজার তৈরি হচ্ছে। এ সবই ভূমিকম্পের জন্য করা হচ্ছে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের হাতে, কাউন্সিলর অফিসে ছোটখাটো যন্ত্রপাতি থাকতে পারে। স্বেচ্ছাসেবীদের ফোন নম্বরও জনগণকে দেওয়া যেতে পারে। দুর্যোগ এলে একজন ফায়ার সার্ভিসকর্মী ১০ জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে কাজ করবেন। এভাবে না এগোলে বড় ধাক্কা সামলানো যাবে না। আর যন্ত্রপাতি আমরা যতই কিনি, সমন্বিতভাবে কাজ না করলে হবে না।

কালের কণ্ঠ : আমাদের প্রকৌশলীদের সক্ষমতার মানটা কেমন?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : এখন আমরা এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারি। তবে আজ থেকে দুই বছর আগেও মাত্র কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমাদের নলেজ লেভেল ছিল। রানা প্লাজা আমাদের সচেতনতার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যখন তিন হাজার ভবন পরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন আমাদের তরুণ প্রকৌশলীদেরও কাজের সুযোগ তৈরি হয়। একটা ভবন ভূমিকম্প সহনীয় কি না তা বলার মতো দক্ষ প্রকৌশলী আগে হয়তো ৫০ থেকে ১০০ জন ছিলেন আমাদের। এখন সংখ্যাটি ৫০০-র মতো হবে।

কালের কণ্ঠ : ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ৭৮ হাজার ভবনের ব্যাপারে বলুন।

মেহেদী আহমেদ আনসারী : তিন লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে ৭৮ হাজার ভবনের কথা আমরা কিন্তু বলেছিলাম ২০০৮ সালে। গত কয়েক বছরে প্রচুর ভবন হয়েছে এবং এখন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হবে সম্ভবত এক লাখ। রানা প্লাজা ধসের পর আমরা পরিদর্শনে গিয়ে যেভাবে কালার কোড দিয়ে গার্মেন্ট বিল্ডিংগুলো চিহ্নিত করেছিল, এখনো একই কাজ করতে পারি। তখন অন্তত এ তথ্যটি জানা থাকবে কোন ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। গার্মেন্টের ক্ষেত্রে তিন হাজার ভবনের মধ্যে ২ শতাংশ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পাই। এখন চার লাখের মধ্যে ৫ শতাংশও যদি পাই, ভবন হবে দুই হাজার। এগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। অ্যাপার্টমেন্ট যাঁরা কিনেন তাঁদেরও সচেতন হতে পারেন। পাঁচ কাঠা জমির ওপর তৈরি ছয়তলা একটি ভবনকে রেট্রোফিট করতে ধরে নিচ্ছি দুই কোটি টাকা খরচ হবে। ২০টি অ্যাপার্টমেন্ট থাকলে মাথাপিছু ১০ লাখ টাকা করে দিলেই তো যথেষ্ট। ব্যাংকের লোন, ইনস্যুরেন্স বা সরকারের ভর্তুকি কোনো একটা উপায়ে এগুলোকে মজবুত করতে কবে।

কালের কণ্ঠ : নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে রড ব্যবহারে ডাকটাইল ডিটেইলের কথা বলা হয়েছে, আপনিও বলছেন। সেটা কি আমাদের এখানে হচ্ছে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : একদম না। এটি হচ্ছে রডটাকে নির্দিষ্ট কোণ পর্যন্ত বাঁকিয়ে দেওয়া, কিন্তু কেউ তো করতে চায় না। আমি এক মিস্ত্রিকে বললাম, তুমি যদি রডটা বাঁকিয়ে দাও, ভূমিকম্প হলে এটা খুলে পড়বে না। মিস্ত্রি বলল, এ জন্য তো ক্লায়েন্ট বাড়তি পয়সা দিচ্ছে না। এখানে আরেকটা ইস্যু হচ্ছে রাজমিস্ত্রি, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের ট্রেনিং দান। কারণ আগে যাঁরা পাস করে গেছেন তাঁদের কিন্তু আধুনিক বিষয়গুলোর নলেজটা নেই। আজকাল যাঁরা পাস করছেন তাঁদের তো আমরাই পড়াচ্ছি। আগের কোর্সগুলোতে অনেক কিছুই ছিল না। ট্রেনিং কিন্তু কিছু হয়েছেও। দুই হাজার রাজমিস্ত্রি, ৫০০ ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, ২০০ বিএসসি প্রকৌশলী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। উদ্যোগটি ব্যাপকতর করতে হবে।

কালের কণ্ঠ : ইস্পাত ভবন নির্মাণের কথা বলছেন কেউ কেউ?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : উঁহু, এটার প্রবলেম আছে, যদি ঠিকঠাক না করা হয়। এটা আসলে স্ট্রাকচারাল চ্যালেঞ্জ। সেবার বুয়েটে একটা নতুন ইনস্টিটিউট হবে- আমি ফাউন্ডার ডাইরেক্টর। বুয়েটে প্রথম ইস্পাতের ভবন হচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন তৈরি করতে গেলাম দেখা গেল আমাদের ছাত্ররা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ রড কংক্রিটে ঢুকিয়েছে। এটা আমাদের বুয়েটে বলে ধরা পড়ল। বাইরে কী হচ্ছে কে জানে! ইস্পাত ভবন এমনিতেই ঠিক আছে, তবে ভূমিকম্পের বিচারে ঝুঁকিপূর্ণ।

কালের কণ্ঠ : রেট্রোফিট প্রক্রিয়াটি আসলে কী?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : উদাহরণস্বরূপ একটি ভবনের কলাম আছে ১০ বাই ১০, ভূমিকম্প সহনীয় ১৫ বাই ১৫ হলে ভবনটি না ভেঙে কলামটি পুরো করে দিতে হবে। এ ধরনের পদ্ধতিতে মজবুতীকরণই হচ্ছে রেট্রোফিট।

কালের কণ্ঠ : আমাদের কিছু কিছু ভবন তো রেট্রোফিট হয়েছে ইতিমধ্যে।

মেহেদী আহমেদ আনসারী : হ্যাঁ। সবচেয়ে অন্যতম হচ্ছে ১৯৮৫-৯০ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনকে মজবুতীকরণ করা হয়। এটি আগে চারতলা ছিল। কলাম ছিলই না। আরেকটা অন্যতম হচ্ছে গুলশান শুটিং ক্লাবের উল্টো দিকে ডিএফডিআইটির একটা বিল্ডিং। আজকাল তো প্রচুর ভবন নতুন করে মজবুত করা হচ্ছে। গত এক বছরে ১০ থেকে ১৫টা গার্মেন্ট ভবন রেট্রোফিট করা হয়। এটা একটু ব্যয়বহুল। দেড় থেকে দুই কোটি টাকা লাগে। তবে আগে দরকার চিহ্নিতকরণ।

কালের কণ্ঠ : ভূমিকম্পের তীব্রতা আমরা কিভাবে পরিমাপ করব?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : তিনটা প্যারামিটারের ওপর আমরা তীব্রতা মাপি। সাধারণ মানুষ কোন প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টি দেখছে। বাসার আসবাবপত্র কিভাবে আচরণ করবে। আমাদের ভবনটি কম বা বেশি কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১৯৮৫ সালে ভূমিকম্প হয় মেক্সিকো সিটি থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে ৮ মাত্রার। সিটিটির চারপাশে পাহাড়, মাঝখানে ভরাট মাটি, আমাদের মতো। ওই ভূমিকম্পের তীব্রতার কারণে পাঁচ থেকে ৩০ তলা ভবন সব ভেঙে ১৫ থেকে ২০ হাজার লোক মারা যায়। ভরাট মাটির কারণে ঢাকায়ও মেক্সিকোর মতো না হলেও কাছাকাছি মাত্রার ভূমিকম্পের সমূহ আশঙ্কা আছে। ছয়টা ভূমিকম্প হয়েছে এখানে ৭.১ থেকে ৮.৭ মাত্রার। এগুলোর ক্ষেত্রেই ঢাকায় তীব্রতা কোথাও ৭, কোথাও ৮ অনুভব করেছি সাধারণ মাটিতে। তবে ভবিষ্যতে ভরাট মাটি এলাকায় ৯ থেকে ১০ তীব্রতা হতে পারে। আর আদি মাটিতে ৮। এটিই আমাদের ভয়ের জায়গা।

কালের কণ্ঠ : আমাদের ক্ষয়ক্ষতি আনুমানিক কেমন হতে পারে বড় কোনো ভূমিকম্পে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : ঢাকায় মোট ভবন এখন তো চার লাখ। বসতি দেড় কোটি। ১৮৯৭ সালের মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হলে শক্ত মাটিতে ৮ ও নরম মাটিতে ৯ তীব্রতা হবে ঢাকায়। এর ফলে ঢাকার প্রায় ২৫ শতাংশ ভবন কম থেকে বেশি বিধ্বস্ত হতে পারে। হতাহত হবে তিন থেকে চার লাখ। ছয় থেকে ৯ বা ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে। বিশ্বব্যাংক ও বুয়েটের উদ্যোগে আমরা একটা যৌথ গবেষণা করেছিলাম। তাতে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়।

আর ড্যাপে বন্যার ঝুঁকিপ্রবণ বলে চিহ্নিত জায়গাগুলোই ভূমিকম্পপ্রবণ বেশি। ভরাট করার মধ্যেও কায়দা আছে। ভরাট করতে হবে প্রতি ছয় ইঞ্চি পর পর দুরমুজ করে। যারা ডেভেলপার তারা তো এগুলো ভাবেই না। তাদের চাই কুইক মানি। এটাকে বলা হয় রিস্ক সেনসেটিভ ল্যান্ড ইউজ প্ল্যানিং- যাতে বন্যাপ্রবণ, ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা সব এলাকা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী তার ব্যবহার করতে হবে। সাম্প্রতিককালে যাঁরা রাজউকের সঙ্গে কনালটেন্সি করছেন, তাঁদের এ ব্যাপারে আমি একটি ব্রিফিং দিয়েছি। রাজউকও একটু-আধটু চিন্তা করছে। এটাকে আরো জোরদার করতে হবে। নরম জায়গায় ভবন তৈরিতে আপত্তি নেই। কিন্তু শক্ত মাটি নিচে যেখানটায় আছে সে পর্যন্ত দুরমুজ করে যেতে হবে। সে জন্য সরকারকে রিস্ক সেনসেটিভ এরিয়া কোনটা তা সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে। বলতে হবে, মাটি ইমপ্রুভ করতে হবে, পাইলিংও দিতে হবে।

কালের কণ্ঠ : নেপালের ভূমিকম্পের তীব্রতা বাংলাদেশে ঠিক কতটা অনুভূত হয়েছে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : শুরুতেই বলে নিই, বাংলাদেশে আমাদের সব সময় এই তীব্রতা নিয়ে কাজ করতে হবে, মাত্রা ৯। নেপালে ভূমিকম্পটা ছিল ৭.৯ মেগনিচিউডের। আমরা যখন ভূমিকম্প সহনীয় ভবনের কথা বলি, তখন কিন্তু মেগনিচিউড না, বলি ইনটেনসিটি বা তীব্রতা- তথা কতখানি ঝাঁকুনি দেবে। মেগনিচিউড হচ্ছে স্রেফ মাত্রা।

আজ পর্যন্ত যত ভূমিকম্প হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ছিল চিলিতে : ৯.২, ১৯৬০ সালে। সুনামি সৃষ্টিকারী ইন্দোনেশিয়ার ২০০৪ সালের ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৯। জাপানে যেটা হলো সেটা ছিল ৯.১। ১০ হয়নি আজও; ১০ মানেই পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ম্যাগনিচিউড হচ্ছে ১ থেকে ১০। আর ইনটেনসিটি বা তীব্রতা ১ থেকে ১২। মাত্রাটা বলা হয়ে থাকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের ক্ষেত্রে। আর এর তীব্রতাটা যত দূরে যাবে তা ক্রমেই কমে যাবে। তো এবার নেপালে এই তীব্রতা ছিল মাটিভেদে শক্ত মাটির ক্ষেত্রে ৯, নরম মাটিতে ১০। আমাদের যে তথ্য-উপাত্ত সে হিসাবে ঢাকায় মাত্রা ছিল লাল মাটিতে ৪ এবং ভরাট মাটিতে ৫।

কালের কণ্ঠ : আমরা আসলে ভূমিকম্পের কতটা ঝুঁকিতে আছি?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : আমাদের অঞ্চলে ১৮৬৯ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত ছয়টি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৮৬৯ সালে ৭.৫ ঢাকা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে, ১৮৮৫ সালে ৭.১ মাত্রার মধুপুরে ঢাকা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে এবং ১৮৯৭ সালে ৮.৭ মাত্রার ঢাকা থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরে। এই ভূমিকম্পটির সময় আহসান মঞ্জিল আংশিক বিধ্বস্ত হয়। তখন নবাব আহসানউল্লাহকে ১৫ দিন তাঁবুতে বাস করতে হয়। ঢাকায় ১০ জনসহ পুরো ভারতে এক হাজার ৫৪২ জন মারা যায়। তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র এক লাখ। পরিধি ছিল ১৫ থেকে ২০ বর্গকিলোমিটার। পাকা ভবন ছিল ১০০-এর মতো। এর মধ্যে ১০টি বা ১২টি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে ছিল আহসান মঞ্জিল ও আরমানিটোলা চার্চ। এখন ঢাকার পরিধি সিটি করপোরেশনে ১২৭ বর্গকিলোমিটার। চারপাশের নদীসহ ধরলে তিন হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার। রাজউকের মধ্যে আছে এক হাজার ৫৩০ বর্গকিলোমিটার। সিটি করপোরেশন এলাকার ৩০ শতাংশই ভরাট মাটি। নদী দিয়ে মাপলে ৬৫ শতাংশ ভরাট এবং ৩৫ শতাংশ আদি মাটি।

ইউএসজিএস অনুমান করছে আগামী এক বছরের মধ্যেই ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হবে এবং এ এলাকায়ই হবে। নেপালের কথাই যদি ধরি, মূল ভূমিকম্পটি হয়েছে কাঠমাণ্ডু থেকে পশ্চিম দিকে। তারপর কয়েকটি আফটার শক হয়েছে এবং সর্বশেষটি হয়েছে দার্জিলিংয়ের দিকে, যার মাত্রা ছিল ৫.৯। প্রথমটি থেকে এটার দূরত্ব ১৫০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার এবং এ ক্ষেত্রে ক্রমেই আফটার শকগুলো পূর্ব দিকে সরে এসেছে। পূর্ব দিক মানেই হচ্ছে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

১৮৬৯ সালের ভূমিকম্প আমাদের দিকে হলো। ১৮৯৭ সালেরটিও এদিকেই হয়েছে, একই রেখা ধরে। ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার দিকে হলো; ২০০৫ সালে কাশ্মীরে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্ব দিকটায় ৮০ থেকে ১০০ বছর ধরে ডরমেন্ট হয়ে আছে। এনার্জি সঞ্চিত হচ্ছে। যেকোনো সময় এর বিচ্ছুরণ হতে পারে। ইউএসজিএস বলছে, আমাদের এই জোনে ২০১৫ সালের ২৬ মে থেকে ২০১৬ সালের ২৬ মের মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে ৭ থেকে ৮ মাত্রার অন্তত একটি হবে, ৬ থেকে ৭ পর্যন্ত অন্তত চারটি হবে এবং ৫ থেকে ৬ পর্যন্ত অন্তত আটটি হবে। কারণ সৃষ্ট ফাটলের নড়াচড়া এখনো থামেনি। এর মধ্যে একটা বড় ভূমিকম্প যদি হয়ে যায় তো হলোই। তারা সেটা অনুমান করতে চাচ্ছে না।

ওরা বলছে, কমপক্ষে ৭ মাত্রার একটা হবেই। আর ৬ থেকে ৭ মাত্রার চারটা হবে। কারণ বড় ভূমিকম্পের পর এক বছর ধরে আফটার শক চলতে থাকে। তাই বলছি, প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া আমাদের গতি নেই। আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। চুলা বন্ধ রাখতে হবে। লিফটে ওঠা যাবে না। ভূমিকম্প চলাকালে নড়াচড়া করা যাবে না। তবে থেমে গেলেই বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ বিল্ডিং দুর্বল হয়ে গিয়ে থাকলে আফটার শকে বিধ্বস্ত হতে পারে।

কালের কণ্ঠ : স্বল্প, মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতিটা আমাদের কী হওয়া উচিত?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : সাধারণ মানুষকেও বিল্ডিং কোডের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ভবনগুলো পরীক্ষার কাজটি তো এখনই শুরু করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে হচ্ছে রাজউক, সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সতর্কতা বোধ তৈরি করা।

কালের কণ্ঠ : সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে আপনাদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আর্থকোয়াক সোসাইটি বা সিভিল সোসাইটি কি ভূমিকা রাখতে পারে না?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : অবশ্যই পারে। যেমন- বাপা বা সুশীল সমাজের নেতৃস্থানীয় যাঁরা আছেন তাঁরা এ নিয়ে কাজ করতে পারেন। আমাদের এখানে যেটা দরকার, প্রধানমন্ত্রীও যেমনটি বলেছেন, আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই, কোনো বড় দুর্যোগ এলে তা কিছুতেই সামাল দিতে পারব না। আমরা ১০-২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করছি। কিন্তু সেটা যে আসলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! নেপালে সে তুলনায় কম ভবন ভাঙলেও আজ দেখলাম ওরা ১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির কথা বলছে।

কালের কণ্ঠ : তো নেপাল থেকে কী শিক্ষা নিলাম আমরা?

মেহেদী আহমেদ আনসারী : তাদের সঙ্গে আমাদের মৌলিক কিছু তফাত আছে। তাদের ইটের গাঁথুনির ভবন অনেক বেশি। তাদের অর্থনীতি ট্যুরিজমের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। আমাদের ওই ধরনের ভবন অনেক কম। আর নেপালে ভূমিকম্প আসা মানে থাবাটা আমাদের ওপর যেকোনো মুহূর্তে আসতে পারে।

কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।

মেহেদী আহমেদ আনসারী : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।